Ads

 রংপুরের ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজ। এই কলেজের ইতিহাসে ১ম নারী শিক্ষার্থী ছিলেন সতী ঘোষ।





তার নিজের ভাষায় সেই সময়ের কলেজের ও তখনকার পরিবেশের বিবরন। 


ত্রিশের দশকে রংপুর কারমাইকেল কলেজ: স্মৃতিচারণ


বাংলাদেশে রংপুর শহরের কারমাইকেল কলেজের ছাত্রী ছিলাম আমি ১৯৩২- ১৯৩৪ এ। ঐ কলেজে আমাকেই প্রথম মহিলা ছাত্রী নেওয়া হয়েছিল, তার আগে মেয়েদের নেওয়া হত না।আমার পরেই সব ক্লাসেই মেয়েদের ভর্তি করা শুরু হয়। আমি ইংরাজীতে অনার্স নিয়ে বি এ পড়তাম এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকেই বি এ পাশ করেছিলাম।


প্রথমেই কলেজের বাড়ীর কথাটা বলি। ইসলামি শিল্প রীতিতে তৈরি বিরাট লম্বা ধরণের একতলা বাড়ী। ছাতের ওপরে একটা খুব জোরালো বাতি জ্বলত, হাজার দুহাজার – কত ওয়াট হবে জানিনা, স্টেশন থেকে দেখা যেত। রংপুর শহরে ঢুকতে স্টেশন থেকে কলেজের প্রাঙ্গণের পাশ দিয়ে যেতে হত। বিরাট মাঠের মধ্যে কলেজের বাড়ী, বিঘে বিঘে জমি, যেন তেপান্তরের মাঠ, মাঠের চারিদিকে দূরে দূরে অধ্যাপকদের ছোট ছোট বাড়ী, ছোট বড় মিলিয়ে ৩/৪ খানা ঘর, বারান্দা দেওয়া।দুটো হস্টেল ছিল, একটা বিজ্ঞানের ছাত্রদের, একটা কলা বিভাগের ছাত্রদের।


আমাদের সময়ে কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ডক্টর ডি এন মল্লিক, কেম্ব্রিজের র‌্যাংলার। প্রেসিডেন্সি কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন, অবসর নিয়ে রংপুর কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে আসেন। ভদ্রলোক ব্রাহ্ম ছিলেন। খুব হাসিখুশী, ফুর্ত্তিবাজ, ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গেও ব্যবহার খুবই ভাল ছিল। পক্ককেশ বৃদ্ধ – মাথার সব চুলই সাদা, কিন্তু ফর্সা গায়ের রং আর বুুদ্ধিপ্রদীপ্ত চেহারা, চলা-ফেরা বৃদ্ধের মত মোটেই ছিলনা, খুব খাটতে পারতেন। ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কাজ করতেন, বাড়ী এত কাছে, তবু টিফিনের সময় বাড়ী যেতেন না, শুধু এক গ্লাশ লেবুর জল খেতেন, ওঁর ঘর পেরিয়ে আমি অনার্স ক্লাস করতে যেতাম। দেখলেই হেসে হেসে বলতেন – “সাহিত্য পড়ে আর কি করবে? অঙ্ক কর, অঙ্কই জীবনে কাজে লাগবে।”


অধ্যাপকদের মধ্যে ইংরাজী অনার্স পড়াতেন – অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় এম এ, পিআরএস। এঁদের মধ্যে অমূল্যবাবু কলকাতার আশুতোষ কলেজে চাকুরী নিয়ে আসেন, প্রিয়রঞ্জন সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজীর লেকচারার হন, সুধাংশুবাবু ইংলণ্ডের লীডস ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি পাশ করে কলকাতা রিপন কলেজে ইংরাজী অধ্যাপক নিযুক্ত হন।


আমার বাবা ড. নগেন্দ্রমোহন গুপ্ত , রংপুর ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি প্রথম বাঙালি ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি থেকে রসায়ন শাস্ত্রে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। ডক্টর মেঘনাদ সাহা আমার বাবার কাছে জার্মান ভাষা শিখেছিলেন। আমার বাবার পিএইচডির বিষয় রসায়ন হলেও বটানিও একটা বিষয় ছিল। তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে আই এ , আই এস সি পরীক্ষার একটা বিষয় বটানির জন্য বটানি বিভাগ খোলান, এবং নিজে সেই বিভাগে বটানি পড়াতেন। আমার ভগ্নীপতি জিতেন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত কারমাইকেল কলেজ থেকে বি এ পাশ করে এম এ তে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে কারমাইকেল কলেজেই অঙ্কের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর নাম করা যেতে পারে। পরে তিনি বি এ পরীক্ষায় বাংলা ভাষায় প্রথম হয়ে “বঙ্কিম মেডেল” পেয়েছিলেন। আর একজন কারমাইকেল কলেজের ছাত্র – রংপুরের তাজহাটের রাজপুরোহিতের ছেলে রবীন্দ্রনাথ মৈত্র “মানময়ী গার্লস স্কুল” লিখে যশস্বী হয়েছিলেন।


কলেজের একটা পত্রিকা ছিল। খুব ভালো ভালো লেখা বেরোত। একজন মেধাবী ছাত্র, গিরিজাপ্রসন্ন রায়চৌধুরী – জমিদারের ছেলে। সংস্কৃত অনার্সে কারমাইকেল কলেজ থেকেই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। আমার বাবার কাছে জার্মান পড়তে আসতেন। বি এ পাশ করবার পরই মেনেনজাইটিস রোগে তাঁর অকালমৃত্যু ঘটে। গিরিজাপ্রসন্ন রবীন্দ্রনাথের “মদনভষ্মের পর” – এর সংস্কৃত পদ্যে অপূর্ব অনুবাদ করেছিলেন, দু-চার লাইন এখনো মনে আছে – কলেজ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখনো মাঝে মাঝে ভাবি, কলেজ-পত্রিকাগুলো রেখে দিলে পারতাম – রংপুরের স্মৃতি।


সম্পাদকের নোট:  ড. সতী ঘোষ (গুপ্ত) ( ১৯১৩-১৯৯২) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্য নিয়ে পিএইচডি করেন। পূর্ববঙ্গে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। দার্জিলিংয়ের মহারাণী গার্লস স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করে ১৯৩০ সালে বেথুন কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ১৯৩২-৩৪ এ রংপুর কারমাইকেল কলেজে ইংরাজীতে বিএ পড়েন।এরপর ১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৩৮ সনে এম এ পাশ করেন। পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক ভূপেন্দ্রনাথ ঘোষের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনের আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে অধ্যাপক সুকুমার সেনের অধীনে গবেষণা করেন



Post a Comment

0 Comments